‘নরেন্দ্র মোদি ভারতের জন্য পাকিস্তানের চেয়েও বড় হু ম কি’

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপির কার্যক্রমকে ঘিরে দেশটির ভেতরে ও বাইরে এক ধরনের উদ্বেগ বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহানের স্বীকারোক্তি—যাতে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষে বিমানবাহিনীর ক্ষতির কথা মেনে নিয়েছেন—তা এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তিন সপ্তাহ ধরে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য গোপন রাখার পর এই স্বীকারোক্তি ভারতের সরকারি বয়ানে বিভ্রান্তির প্রমাণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকদের মতে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী আদর্শের রাজনীতি কেবল প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্য নয়, স্বয়ং ভারতের ভেতরেও বিপজ্জনক প্রভাব ফেলছে। মোদির শাসনকালকে অনেকেই ‘ধর্মীয় উগ্রতা’ ও ‘মিথ্যা প্রচার’-এর সাথে তুলনা করছেন, যেখানে বিরোধীদের দমন এবং ঐতিহাসিক সত্য বিকৃত করার প্রবণতা লক্ষণীয়।

গান্ধী হত্যার আদর্শিক সূত্রপাত আরএসএস-এ

মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন আরএসএস-এর সদস্য। যদিও তিনি দাবি করেছিলেন সংগঠনটি তিনি ছেড়েছেন, কিন্তু বিবিসির একটি অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি আজীবন আরএসএস-এর সাথেই যুক্ত ছিলেন। আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, আজকের অনেক বিজেপি নেতা গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে সম্মান জানান, যা ভারতের রাজনৈতিক ও নৈতিক বিবেচনায় গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়।

আরএসএস ও বিজেপি—একই আদর্শের ভিন্ন রূপ

আরএসএস-এর অতীত রীতিমতো বিতর্কিত। বিভিন্ন সময় তারা সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পর, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় সংগঠনটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। এছাড়া, ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা ও সংবিধান নিয়েও সংগঠনটির নেতারা আপত্তি জানিয়েছেন। এম.এস. গোলওয়ালকর যেমন তাঁর বইতে গেরুয়া পতাকার পক্ষে অবস্থান নেন।

ধর্মীয় উগ্রতা সেনাবাহিনীতেও?

২০২৫ সালের মে মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্রর বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা জগদগুরু রামভদ্রাচার্যের সঙ্গে পোশাক পরিহিত অবস্থায় সাক্ষাৎ ভারতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। এই ধর্মগুরু বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর সহিংসতাকে সমর্থন করেন।

‘অখণ্ড ভারত’ ও সম্প্রসারণবাদী মানসিকতা

বিজেপি ও আরএসএস-এর ‘অখণ্ড ভারত’ স্বপ্ন আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সংসদে প্রদর্শিত একটি মানচিত্রে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এমনকি মিয়ানমার পর্যন্ত ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন একে ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী।

‘ঘর ওয়াপসি’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে অ-হিন্দুদের হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনাও এই আদর্শিক সম্প্রসারণেরই অংশ।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই না, বরং মদদ?

পাকিস্তানে মে ২০২৫-এ চালানো হামলার পেছনে মোদির সরকার মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম—বিশেষ করে দ্য গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্ট—ভারতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। এমনকি ‘My Enemy’s Enemy’ গ্রন্থে ভারত-পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর যোগসূত্র নিয়েও বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে।

RAW-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘বঙ্গভূমি’ নামে একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টার তথ্যও সামনে এসেছে, যা সরাসরি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার ওপর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

একটি বিপজ্জনক ত্রয়ী

একজন ‘কসাই’ খ্যাত প্রধানমন্ত্রী, আরএসএস-এর উগ্রবাদী নেতৃত্ব এবং একটি ধর্মীয়ভাবে প্রভাবিত সেনাবাহিনী—এই ত্রয়ী আজ ভারতের গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একতাবদ্ধ হয়ে এই সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবস্থান নেওয়ার।

উপসংহার

সব ভারতীয় হিন্দুই মোদি কিংবা আরএসএস-এর আদর্শকে সমর্থন করেন না। অনেকেই এই উগ্রবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন উগ্রপন্থা বজায় থাকলে, তা কেবল ভারতের গণতন্ত্র নয়, গোটা উপমহাদেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন