বেশিক্ষণ রোদে থাকলে কি হয় জেনে নিন

দেশজুড়ে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। একদিকে ভ্যাপসা গরম, অন্যদিকে প্রচণ্ড রোদে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘসময় রোদে থাকলে শরীরে মারাত্মক ধরনের ক্ষতি হতে পারে। শুধু অস্বস্তি নয়, প্রাণঘাতী রোগও দেখা দিতে পারে।

গবেষণা ও চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, গরমে সরাসরি রোদে বেশিক্ষণ থাকলে হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, সানবার্ন, মাথাব্যথা, ক্লান্তি এবং কিডনি জটিলতা পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি।

এই প্রতিবেদনটিতে আমরা জানব গরমে বেশিক্ষণ রোদে থাকলে শরীরের কী ধরনের ক্ষতি হয়, এর উপসর্গ কী, কারা বেশি ঝুঁকিতে, এবং প্রতিরোধে কী করণীয়।


---

হিট স্ট্রোক: প্রাণঘাতী বিপদ

চিকিৎসাবিজ্ঞানে হিট স্ট্রোককে বলা হয় তীব্র তাপজনিত অসুস্থতা। মূলত শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি পৌঁছালে এই অবস্থা তৈরি হয়। দীর্ঘসময় রোদে কাজ করলে বা চলাফেরা করলে শরীর স্বাভাবিকভাবে ঘাম তৈরি করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে ঘাম উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে শরীর দ্রুত গরম হতে শুরু করে, যার ফলে হিট স্ট্রোক হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফারজানা হক বলেন, “হিট স্ট্রোক হলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, এমনকি চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুও হতে পারে। জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দিলেও সাধারণ জ্বরের চেয়ে এটি অনেক ভয়ংকর।”

হিট স্ট্রোকের লক্ষণ:

খুব দ্রুত বা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন

মাথা ঘোরা বা বিভ্রান্তি

তীব্র মাথাব্যথা

গা শুকিয়ে যাওয়া (ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া)

বমি বমি ভাব বা বমি

ত্বকের রঙ লালচে হয়ে যাওয়া

অজ্ঞান হয়ে যাওয়া



---

ডিহাইড্রেশন: পানিশূন্যতায় শরীরের বিপর্যয়

রোদের মধ্যে শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। যদি সেই পানি পূরণ না করা হয়, তাহলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, যাকে বলা হয় ডিহাইড্রেশন। এতে করে রক্তচাপ কমে যেতে পারে, কিডনির কার্যকারিতা ব্যাহত হয় এবং মাথা ঝিমঝিম করে।

বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে ডিহাইড্রেশন খুব দ্রুত হয়। কারণ তাদের শরীরে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম।


---

সানবার্ন ও ত্বকের ক্ষতি

রোদের আল্ট্রাভায়োলেট (UV) রশ্মি সরাসরি ত্বকে পড়লে সানবার্ন হতে পারে। এটি ত্বকের উপরের স্তর পুড়িয়ে ফেলে। বাংলাদেশের মতো গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় রোদে হাঁটা-চলা বা বাইরে কাজ করলেই অনেকের গালে, কাঁধে, ঘাড়ে লালচে দাগ বা জ্বালাপোড়া দেখা যায়।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তানজিনা সুলতানা বলেন, “সানবার্ন ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। কিছুক্ষেত্রে ত্বকের ক্যানসারের ঝুঁকিও তৈরি হয় যদি নিয়মিত সুরক্ষা ছাড়া রোদে ঘোরা হয়।”


---

কিডনির উপর প্রভাব

ডিহাইড্রেশন শুধু সাময়িক অস্বস্তি নয়, দীর্ঘমেয়াদে কিডনির জন্য হুমকিস্বরূপ। শরীরে পর্যাপ্ত পানি না থাকলে কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। প্রস্রাব কমে যায় এবং এর রঙ ঘন হয়ে পড়ে। দীর্ঘসময় এই অবস্থা চলতে থাকলে কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়।


---

হিট এক্সহসশান: শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম

রোদে বেশি সময় কাজ করলে বা হাঁটলে শরীরের শক্তি দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়। একে বলা হয় হিট এক্সহসশান। এই অবস্থায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, মাথা ঝিমঝিম করে, অনেক সময় চলাফেরা করাও কষ্টকর হয়ে পড়ে।

এমন পরিস্থিতিতে রক্তে সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের পরিমাণ কমে যেতে পারে, যা হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকলাপেও ব্যাঘাত ঘটায়।


---

কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?

গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ গরমে বেশিক্ষণ রোদে থাকলে বেশি ক্ষতির শিকার হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

শিশু ও বৃদ্ধ

গর্ভবতী নারী

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগী

যারা দিনে বাইরে কাজ করেন (যেমন নির্মাণ শ্রমিক, ট্রাফিক পুলিশ, রিকশাচালক)

খেলোয়াড় বা যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন



---

কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়?

গরমে দীর্ঘসময় রোদে থাকার ক্ষেত্রে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকরা যেসব পরামর্শ দেন:

১. প্রয়োজন ছাড়া রোদে বের হবেন না: সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রোদ সবচেয়ে তীব্র থাকে। এ সময় বাইরে না যাওয়াই ভালো।
২. ঢিলেঢালা ও হালকা রঙের কাপড় পরুন: এই ধরনের কাপড় শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
৩. ছাতা, টুপি বা সানগ্লাস ব্যবহার করুন: এগুলো রোদের তাপ ও UV রশ্মি থেকে রক্ষা করে।
৪. প্রচুর পানি পান করুন: দিনে অন্তত ২.৫ থেকে ৩ লিটার পানি পান করা উচিত।
৫. ORS বা শরবত খেতে পারেন: ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে লবণ-পানি বের হয়ে যায়। তাই ওরস্যালাইন বা লবণ-চিনি মিশ্রিত পানি খেলে উপকার হয়।
৬. সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন: যারা বাইরে যান, তাদের উচিত SPF ৩০ বা তার বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন সানস্ক্রিন ব্যবহার করা।
৭. যদি কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, অবহেলা নয়: মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত দুর্বলতা বা বমি ভাব দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


---

শেষ কথা

বাংলাদেশের আবহাওয়া দিনদিন উষ্ণতর হচ্ছে। শহরের কংক্রিট, যানবাহনের ধোঁয়া, এবং বৃক্ষহীনতা এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। এই অবস্থায় রোদে ঘোরাফেরা বা কাজ করা বাধ্যতামূলক হলেও, সচেতন না হলে জীবন সংশয়ের আশঙ্কা থেকে যায়।

গরমে রোদে থাকাটা যতটা সম্ভব সীমিত রাখা, প্রচুর পানি পান করা, সঠিক পোশাক পরিধান এবং প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সচেতনতা অবলম্বন করলেই এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন