চৈত্রের রোদ যেমন দিগন্ত ফাটায়, ঠিক তেমনই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের গরম মানুষের শরীরের ভেতরের সমস্ত প্রশান্তি যেন শুষে নেয়। এ সময় শুধু শরীরের ত্বক নয়, মাথার ত্বকও নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে অতিরিক্ত ঘাম, ধুলাবালি ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে মাথার ত্বকে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি।
অনেকেই খেয়াল করেন না যে, মাথার ত্বক শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর। এর যত্নে অবহেলা করলে খুশকি, ফাঙ্গাল ইনফেকশন, ফোলাসাইটিস, চুলকানি, লালচে দাগ, চুল পড়া এমনকি পুঁজযুক্ত ফোড়া পর্যন্ত হতে পারে।
তবে একটু সচেতন হলে এই গরমেও মাথার ত্বককে সংক্রমণমুক্ত ও সুস্থ রাখা সম্ভব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিউটি এক্সপার্টদের মতামত এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে গরমে মাথার ত্বক সুরক্ষায় কিছু কার্যকর পরামর্শ তুলে ধরা হলো:
---
১. নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
গরমে সবচেয়ে বেশি মাথার ত্বকে ঘাম জমে থাকে। সেই সঙ্গে ধুলাবালি ও বাইরের দূষণ মাথার ত্বকে বসে থেকে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। তাই নিয়মিত শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, সপ্তাহে অন্তত তিনবার মাইল্ড হার্বাল শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলা উচিত। তবে খুব বেশি শ্যাম্পু করলেও মাথার ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, তাই ভারসাম্য রাখতে হবে।
শ্যাম্পুর পর ভালোভাবে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। শ্যাম্পু করার পর চুল ভেজা অবস্থায় বেশিক্ষণ না রাখা, দ্রুত শুকিয়ে নেওয়া উচিত। কারণ ভেজা চুলে ব্যাকটেরিয়া সহজেই জন্মাতে পারে।
---
২. টুপি বা হেলমেট ব্যবহারে সতর্ক থাকুন
অনেকে বাইক চালাতে গিয়ে দীর্ঘ সময় হেলমেট পরেন। আবার কেউ কেউ রোদ থেকে বাঁচতে টুপি ব্যবহার করেন। কিন্তু হেলমেট বা টুপির ভেতর পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল না থাকলে ঘাম জমে মাথার ত্বকে জীবাণু সংক্রমণ ঘটে।
এ কারণে নিয়মিত হেলমেটের অভ্যন্তরীণ অংশ পরিষ্কার করা জরুরি। এছাড়া যাঁরা কাপড়ের টুপি ব্যবহার করেন, তাঁদের উচিত অন্তত দুই দিন পরপর ধুয়ে নেওয়া।
এছাড়া হেলমেট পরার আগে মাথায় পাতলা সুতির কাপড়ের একটি স্কার্ফ বা ব্যান্ড পরা যেতে পারে, যা ঘাম শোষে নেয় এবং ত্বককে সুরক্ষা দেয়।
---
৩. চুলের স্টাইলিং প্রোডাক্ট ব্যবহারে সাবধান
গরমের সময় অতিরিক্ত হেয়ার জেল, ওয়্যাক্স বা স্প্রে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। এই সব পণ্যে থাকা রাসায়নিক উপাদানগুলো মাথার ত্বকে ঘাম ও ধুলার সংস্পর্শে এসে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।
যাঁরা নিয়মিত হেয়ার স্টাইলিং করেন, তাঁদের উচিত রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই চুল ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা।
---
৪. প্রাকৃতিক উপায়ে মাথার ত্বকের যত্ন
গরমে মাথার ত্বকের সংক্রমণ এড়াতে ঘরোয়া কিছু উপায় খুব কার্যকর। যেমন:
নিমপাতা ও পানি: কয়েকটি নিমপাতা ফুটিয়ে সেই পানি ঠাণ্ডা করে মাথায় ঢালুন। এটি অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে কাজ করে এবং খুশকি ও চুলকানি দূর করে।
অ্যালোভেরা জেল: অ্যালোভেরা মাথার ত্বকে শীতলতা আনে এবং জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। সপ্তাহে ২ বার অ্যালোভেরা জেল লাগালে ফাঙ্গাল ইনফেকশন কমে।
টক দই: দইয়ে থাকা প্রোবায়োটিক উপাদান মাথার ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক রাখতে সহায়তা করে।
---
৫. পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত পানি পান
শুধু বাইরের যত্ন নয়, ভেতর থেকে শরীর সুস্থ না থাকলে মাথার ত্বকের সমস্যা বাড়তে পারে। তাই সুষম খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে, যাতে শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে। সঙ্গে ফলমূল, শাকসবজি ও ভিটামিন-বি সমৃদ্ধ খাবার চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী।
যাঁদের দেহে আয়রন, জিঙ্ক বা বায়োটিনের ঘাটতি আছে, তাঁদের মাথার ত্বকে খুশকি, চুল পড়া ও অন্যান্য ইনফেকশন বেশি হতে দেখা যায়। তাই প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
---
৬. নিয়মিত হেয়ার ব্রাশ পরিষ্কার করুন
চুল আঁচড়ানোর জন্য ব্যবহৃত ব্রাশ বা চিরুনিতে ধুলাবালি ও মৃত কোষ জমে থাকে। এগুলো পরিষ্কার না করলে প্রতিবার চুল আঁচড়ানোর সময় জীবাণু মাথার ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে।
সপ্তাহে অন্তত একবার ব্রাশ বা চিরুনি সাবান দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করুন।
---
৭. মাথা চুলকানো থেকে বিরত থাকুন
গরমে ঘাম ও ধুলার কারণে অনেক সময় মাথা চুলকায়। কিন্তু ঘনঘন মাথা চুলকানো ত্বকে ক্ষতি করতে পারে এবং ইনফেকশনের প্রবণতা বাড়ায়। এমনকি নখের নিচে থাকা জীবাণু ত্বকে ঢুকে যেতে পারে।
চুলকানি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিফাঙ্গাল লোশন বা মেডিকেটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত।
---
৮. চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না
গরমে মাথার ত্বকে যদি লালচে দাগ, ফুসকুড়ি, অতিরিক্ত চুলকানি বা পুঁজযুক্ত ফোড়া দেখা দেয়, তবে অবহেলা না করে দ্রুত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অনেক সময় এগুলো স্ক্যাল্প ডার্মাটাইটিস, ফোলিকুলাইটিস বা টিনিয়া ক্যাপিটিসের মতো সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে।
---
শেষ কথা
গরমকালে মাথার ত্বকের সঠিক যত্ন নেওয়া শুধু চুল ভালো রাখার জন্য নয়, ত্বকের সুস্থতা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে কিছু ছোট ছোট অভ্যাস গড়ে তুললেই মাথার ত্বককে সংক্রমণমুক্ত, সুস্থ ও সতেজ রাখা সম্ভব।
পরিচ্ছন্নতা, সুষম খাদ্যাভ্যাস ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা—এই তিনটি বিষয় মাথায় রাখলেই গরমে মাথার ত্বকের সংক্রমণ আর ভয় নয়, বরং থাকবে স্বস্তি ও সতেজতা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন