আপনি কি এই গরমে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খান? কী হয়, জানেন?

বাংলাদেশে প্রচণ্ড গরমের সময়ে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করা যেন এক ধরনের স্বস্তির নাম। ঘরে ফ্রিজে রাখা বরফঠান্ডা পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটানোর অভ্যাস অনেকের। বাইরে গরমে হাঁসফাঁস করার পর বাসায় ফিরে ঠান্ডা পানি এক ঢোক খেলেই যেন প্রাণ ফিরে আসে। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই আরামদায়ক ঠান্ডা পানিই আপনার শরীরের জন্য হতে পারে বিপজ্জনক? হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞদের মতে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি নিয়মিত খাওয়ার ফলে শরীরে দেখা দিতে পারে নানা রকম শারীরিক জটিলতা, এমনকি তা দীর্ঘমেয়াদে হতে পারে প্রাণঘাতীও।

ঠান্ডা পানি কেন বিপজ্জনক?

মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা গড়ে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু ফ্রিজে রাখা পানি সাধারণত ৫ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। অতএব, এই অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলেই শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে এক ধরনের সংঘর্ষ তৈরি হয়, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে “Thermal Shock”।

এই Thermal Shock-এর কারণে হঠাৎ করে শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে, তাদের জন্য এই ঠান্ডা পানি হতে পারে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, ঠান্ডা পানি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকে জ্বালা, ব্যথা কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা শুরু হয়।

হজম প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব

চিকিৎসকরা জানান, ঠান্ডা পানি হজম প্রক্রিয়ায়ও সমস্যা সৃষ্টি করে। আমাদের পাকস্থলীতে থাকা পাচক রস বা এনজাইমের কার্যকারিতা কমে যায় ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে। ফলে খাবার সহজে হজম হয় না। এটি ধীরে ধীরে বদহজম, পেট ফাঁপা, অ্যাসিডিটি ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেক সময় দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে গ্যাস্ট্রিক আলসার পর্যন্ত হতে পারে।

পুষ্টিবিদদের মতে, খাওয়ার পরপরই ঠান্ডা পানি পান করলে তা পাকস্থলীতে থাকা চর্বি জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ফলে ওজন বাড়ার প্রবণতাও তৈরি হয়।

ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে দেয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠান্ডা পানি নিয়মিত খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। ঠান্ডা পানির কারণে গলায় ইনফেকশন, ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশির প্রবণতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। কারণ, তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র গবেষণায়ও বলা হয়েছে, নিয়মিত ঠান্ডা পানি পান করলে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। ফলে সহজেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে।

হৃদরোগ ও স্নায়ুব্যাধির ঝুঁকি

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ করে খুব ঠান্ডা পানি খাওয়ার ফলে হৃৎপিণ্ডের গতি (Heart Rate) কমে যেতে পারে। অনেক সময় এটি হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করে। এছাড়া ঠান্ডা পানি পান করার ফলে স্নায়ুতে তীব্র সংকোচন হয়, যা মাইগ্রেন বা মাথাব্যথার প্রকোপ বাড়ায়।

অনেক সময় ঠান্ডা পানি খাওয়ার পর হঠাৎ মাথা ধরে, চোখে অন্ধকার দেখা দেয় বা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এই উপসর্গগুলোকে চিকিৎসকরা “Cold Stimulus Headache” বলেন।

শরীরের বিপাকক্রিয়ায় (Metabolism) বিঘ্ন

সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে পানির তাপমাত্রাও শরীরের কাছাকাছি হওয়া উচিত। ঠান্ডা পানি শরীরে প্রবেশ করলে শরীর তখন তা গরম করতে শক্তি ব্যয় করে। এতে বিপাকক্রিয়ার স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয়। যার প্রভাবে ক্লান্তি, মাথাব্যথা বা ঝিমঝিম ভাব অনুভূত হয়।

যারা একদমই ঠান্ডা পানি খাবেন না

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, যাদের শ্বাসকষ্ট, টনসিল, অ্যালার্জি, গলা ব্যথা, হজমের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ আছে—তাদের একেবারেই ঠান্ডা পানি খাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের এই গরমে ঠান্ডা পানি থেকে দূরে থাকাই ভালো।

তাহলে কি গরমে ঠান্ডা পানি একেবারেই নয়?

না, একেবারেই না বলার সুযোগ নেই। তবে তা হতে হবে স্বাভাবিক ঠান্ডা, অর্থাৎ সাধারণ কলের পানি বা মাটির কলসিতে রাখা পানি। এ ধরনের পানি শরীরের জন্য উপকারী এবং সহজে তৃষ্ণাও মেটে। কেউ যদি একটু ঠান্ডা পানি খেতেই চায়, তাহলে পানির তাপমাত্রা যেন ১৫-২০ ডিগ্রির বেশি ঠান্ডা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

তাছাড়া ফ্রিজ থেকে পানি বের করেই সরাসরি খেয়ে ফেলা খুবই ক্ষতিকর। যদি পান, তবে কিছুক্ষণ রেখে পান করা উচিত।

বিকল্প কী হতে পারে?

এই গরমে ঠান্ডা পানির বিকল্প হতে পারে কিছু প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর উপাদান। যেমন—

মাটির কলসিতে রাখা পানি: প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা এবং শরীরের জন্য নিরাপদ।

লেবু পানি বা শরবত: ঘরে তৈরি লেবু পানি শরীর ঠান্ডা রাখে এবং তৃষ্ণাও মেটায়।

ডাবের পানি: প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ, শরীর ঠান্ডা রাখে ও পানিশূন্যতা পূরণ করে।

ফলের রস (সুগার ফ্রি): তাজা ফলের রস ঠান্ডা রাখে এবং শরীরে পুষ্টি যোগায়।


বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শাহীন আরা জানান,

> “এই প্রচণ্ড গরমে অনেকেই ঠান্ডা পানি খেয়ে আরাম পেতে চান। কিন্তু তারা জানেন না, এই স্বস্তিই অনেক সময় শরীরের ভেতর বড় ক্ষতি করে দেয়। নিয়মিত ঠান্ডা পানি খেলে শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, হজমে সমস্যা হয়, এমনকি হৃদযন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই বরফঠান্ডা পানি পরিহার করা উচিত।”



শেষ কথা

গরমে আরাম পাওয়ার জন্য আমরা অনেক সময় শরীরের ক্ষতির কথা ভুলে যাই। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি সাময়িক স্বস্তি দিলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আমাদের শরীরের ওপর পড়ছে চুপিসারে। তাই একটু সচেতন হলেই অনেক বড় বিপদ এড়ানো যায়। শরীর সুস্থ রাখতে পানি খাবেন ঠিকই, তবে সেটা যেন হয় শরীরবান্ধব তাপমাত্রায়—এই সচেতনতা হতে পারে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন