বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে আবারও টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি সীমান্তে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ বা পুশইনের ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। একই সময়ে ভারতের নতুন সমুদ্রপথ করিডর প্রকল্প ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে পরিচালিত হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে নানা বিষয়ে মতবিরোধ বাড়তে থাকে। এরইমধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটানোর অভিযোগে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ শুক্রবার ভোরে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার রামপুর সীমান্তে ১৭ জন বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিজিবি। একই সময় মৌলভীবাজারেও একাধিক অনুপ্রবেশের চেষ্টা প্রতিহত করা হয়।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পুশইন কার্যক্রম কেবল মানবিক ও আইনগতভাবে অগ্রহণযোগ্যই নয়, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। আন্তর্জাতিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি উপেক্ষা করে মানুষ পাঠানো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী বলেও তারা মন্তব্য করেন।
ভারতের নতুন সমুদ্র করিডর পরিকল্পনা
বাংলাদেশকে বাইপাস করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডকে যুক্ত করতে বিকল্প সমুদ্র করিডর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি। শিলং থেকে শিলচর পর্যন্ত প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের কাজ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। এই করিডর ভারতের এনএইচ-৬ এর অংশ হিসেবে মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে নির্মিত হচ্ছে।
এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নির্ভরতা হ্রাসের স্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এতে দুই দেশের আঞ্চলিক সমন্বয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
৩৭০ জনকে পুশইন, অধিকাংশই বাংলাদেশি
সর্বশেষ সরকারি তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ভারত থেকে ৩৭০ জনকে পুশইন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৩ জন বাংলাদেশি, ১৯ জন রোহিঙ্গা এবং বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। সাতক্ষীরায় কোস্ট গার্ড আটক করেছে ৭৮ জনকে, যাদের মধ্যে তিনজন ভারতীয় নাগরিক। ৪ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত পাঁচটি সীমান্ত দিয়ে ১৬৭ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
এছাড়া শ্যামনগরের পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৯ মে বিএসএফ ৭৮ জনকে ফেলে রেখে যায়, যাদের অনেকেই নিখাদ শারীরিক দুরবস্থায় ছিলেন।
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের নীতিতে অটল। তিনি বলেন, “যদি কোনো ব্যক্তি প্রকৃত বাংলাদেশি হন, তবে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু অন্য দেশের নাগরিক হলে তাকে বৈধ প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠানো হবে।”
তিনি আরও জানান, ভারতকে কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত আছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, “পুশইন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় নিরপরাধ মানুষ সীমান্ত পার হতে বাধ্য হন, যা কেবল মানবিক সংকট নয়, বরং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগও তৈরি করে।”
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান জানান, একতরফাভাবে লোক পাঠানো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন ও দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা লঙ্ঘনের সামিল। তিনি বলেন, “এ ধরনের পদক্ষেপ দ্বিপক্ষীয় আস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন