লেখক: বিশেষ প্রতিবেদক, স্বাস্থ্য ও জীবনধারা বিভাগ
বাংলাদেশের গ্রামীণ হাট থেকে শুরু করে শহরের সুপারশপ—সর্বত্রই সহজলভ্য একটি ফল পেয়ারা। দামেও সাশ্রয়ী, সারা বছরই পাওয়া যায়, খেতেও সুস্বাদু। তবে অনেকেই জানেন না, এই ফলটির মধ্যে লুকিয়ে আছে অসাধারণ পুষ্টিগুণ, যা শরীরের নানা জটিল রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেয়ারা শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এটি থাকা উচিত স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য।
এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো পেয়ারা খাওয়ার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক উপকারিতা, পুষ্টিগুণ, এবং এটি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সুস্থতার অনুঘটক হতে পারে।
১. পুষ্টিগুণে ভরপুর পেয়ারা
পেয়ারা এমন একটি ফল, যার প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে প্রায় ৬৮ কিলোক্যালরি শক্তি, ১৪ গ্রাম শর্করা, ৫ গ্রাম খাদ্যআঁশ, ২.৬ গ্রাম প্রোটিন এবং প্রায় ২২৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পেয়ারা একটি কমলালেবুর চেয়েও প্রায় চারগুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ সরবরাহ করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
মূল পুষ্টিগুণ সমূহ:
-
ভিটামিন সি
-
খাদ্যআঁশ
-
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
-
ফলিক অ্যাসিড
-
পটাশিয়াম
-
ম্যাগনেশিয়াম
-
ভিটামিন এ ও বি-কমপ্লেক্স
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ভিটামিন ‘সি’-এর প্রাচুর্য এই ফলকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য আদর্শ করে তোলে। নিয়মিত পেয়ারা খেলে সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা, ভাইরাল সংক্রমণসহ নানা ঋতুজনিত অসুখের ঝুঁকি কমে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পরে যে বিষয়টি উঠে এসেছে—রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, তাতে পেয়ারা হতে পারে ঘরোয়া এক অস্ত্র।
৩. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস এখন একটি নীরব ঘাতক। গবেষণা বলছে, পেয়ারা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এর খাদ্যআঁশ এবং কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়তে দেয় না। এমনকি পেয়ারা পাতার নির্যাসও রক্তে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে।
৪. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
পেয়ারা খাওয়ার একটি অন্যতম বড় উপকারিতা হলো এটি হজমপ্রক্রিয়া সহজ করে। এর মধ্যে থাকা খাদ্যআঁশ অন্ত্রে পচনশীল ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা অম্লতা সমস্যায় ভুগলে প্রতিদিন সকালে একটি পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা।
৫. হার্টের সুস্থতা বজায় রাখে
হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ হলো রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল। পেয়ারা এই কোলেস্টেরল কমিয়ে এনে হৃদপিণ্ডকে সুরক্ষা দেয়। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং পটাশিয়াম, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ধমনির গায়ে চর্বি জমা হতে বাধা দেয়।
৬. ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক
গবেষণায় দেখা গেছে, পেয়ারা ও এর পাতার নির্যাসে রয়েছে লাইकोপিন, ক্যারোটিনয়েড ও ফ্ল্যাভোনয়েড নামক শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা কোষের ক্ষয়রোধ করে এবং ক্যানসার কোষের বৃদ্ধিকে ধীর করে। বিশেষ করে প্রোস্টেট ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে পেয়ারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
৭. ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য পেয়ারা হতে পারে একটি আদর্শ স্ন্যাকস। এতে চর্বির পরিমাণ প্রায় শূন্য, শর্করার পরিমাণও নিয়ন্ত্রিত। খাদ্যআঁশ থাকার ফলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে, ক্ষুধা কম লাগে এবং অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে।
৮. ত্বক ও চুলের যত্নে উপকারী
পেয়ারা ত্বকের বলিরেখা, ডার্ক স্পট, ও ব্রণের বিরুদ্ধে কাজ করে। এর ভিটামিন ‘সি’ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ত্বকে কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা ত্বককে রাখে টানটান ও উজ্জ্বল। চুলের গোড়া মজবুত করতেও পেয়ারা পাতার পেস্ট ব্যবহৃত হয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়।
৯. মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে
ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন বি-৬-এর উপস্থিতির কারণে পেয়ারা স্নায়ু শান্ত রাখতে সাহায্য করে। মানসিক চাপ কমাতে এবং ঘুমের গুণমান বাড়াতে নিয়মিত পেয়ারা খাওয়া যেতে পারে। এমনকি পরীক্ষার সময় মানসিক চাপ কমাতে অনেক শিক্ষার্থী পেয়ারা খাওয়া শুরু করেছেন।
১০. গর্ভবতী নারীদের জন্য উপকারী
পেয়ারা ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি-৯-এর সমৃদ্ধ উৎস। যা গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের নিউরাল টিউব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটি নিরাপদ ও উপকারী ফল, তবে অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়।
বিভিন্নভাবে খাওয়ার উপায়
পেয়ারা কেবল কাটাই নয়, বিভিন্নভাবে খাওয়া যেতে পারে:
-
পেয়ারা জুস
-
পেয়ারা চাটনি বা আচার
-
পেয়ারা স্মুদি
-
পেয়ারা পাতার চা
-
সালাদে পেয়ারা
-
মিক্সড ফল হিসেবে স্ন্যাকসে
এছাড়া কাঁচা পেয়ারা, পাকা পেয়ারা কিংবা ‘রেড ফ্লেশ’ জাতের গোলাপি পেয়ারা সবই উপকারী।
পেয়ারা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
অনেকেই মনে করেন, পেয়ারা খেলে পেটব্যথা বা গ্যাসের সমস্যা হয়। এটি সাধারণত ঘটে যদি পেয়ারা খুব বেশি পাকা বা অতি খাওয়ার ফলে হয়। পুষ্টিবিদরা বলছেন, পরিমাণমতো খেলে কোনো সমস্যা হয় না বরং উপকারই হয়।
বাংলাদেশের যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বরিশাল এবং গাইবান্ধা অঞ্চলে পেয়ারা চাষ এখন একটি লাভজনক কৃষি উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বারোমাসি পেয়ারা চাষ করে অনেক কৃষক এখন স্বনির্ভর হচ্ছেন। সরকারি সহায়তা ও বাজারজাতকরণে সহযোগিতা পেলে পেয়ারা হতে পারে রপ্তানিযোগ্য একটি ফল।
চিকিৎসকদের পরামর্শ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ডা. শারমিন আহমেদ বলেন,
"প্রতিদিন এক থেকে দুইটি পেয়ারা খাওয়া শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তবে যাদের কিডনি সমস্যা বা অতিরিক্ত পটাশিয়ামের কারণে খাবারে বিধিনিষেধ আছে, তারা চিকিৎসকের পরামর্শে খাবেন।"
একটি ছোট্ট, সস্তা ফল—যার মধ্যে রয়েছে এমন বৈচিত্র্যময় পুষ্টিগুণ, তা সচেতনতার অভাবে অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। এখন সময় সচেতন হয়ে এই সহজলভ্য ফলকে আমাদের খাদ্যতালিকার নিয়মিত অংশ বানানোর। পেয়ারা শুধু আমাদের শরীরই নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিও সুস্থ রাখতে পারে—যদি আমরা এর সঠিক ব্যবহার জানি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন