বিশেষ প্রতিবেদন | ঢাকা, এপ্রিল ৩০, ২০২৫
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতের গুজরাট রাজ্যে কথিত অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করতে শুরু হওয়া পুলিশি অভিযানে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাভাষী মুসলিমদের মধ্যে। রাজ্যজুড়ে পরিচালিত এই বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬,৫০০ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে পুলিশের দাবি অনুযায়ী, এদের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জনের প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
অন্যদিকে, বাকিদের বড় অংশই ভারতীয় নাগরিক, যাদের অনেকের কাছে বৈধ আধার কার্ড, ভোটার আইডি এমনকি ভারতীয় পাসপোর্টও রয়েছে। তবুও শুধুমাত্র ভাষাগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গুজরাট পুলিশের ডিজি বিকাশ সহায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআই-কে জানিয়েছেন, "এখন পর্যন্ত যাদের পরিচয়পত্র যাচাই করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জন প্রকৃত বাংলাদেশি। বাকিদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে, তবে এদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাগরিক।"
রাজ্যজুড়ে ধরপাকড়, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
প্রাথমিকভাবে আহমেদাবাদ ও সুরাতে চালু হওয়া এই অভিযান ধীরে ধীরে পুরো গুজরাট জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অভিযান পরিচালিত হয় মূলত ভোররাতে ও মধ্যরাতে, যার ফলে স্থানীয় মুসলিম বসতিগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ।
সুরাতের এক বাসিন্দা সুলতান মল্লিক, যিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার স্থায়ী নাগরিক, তাকে দুই ভাগ্নেসহ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী সাহিনা বিবি অভিযোগ করেন, “পুলিশ বলেছিল কিছু সময়ের মধ্যেই ছেড়ে দেবে, কিন্তু তিন দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো তাদের খোঁজ নেই।”
সামাজিক অনুষ্ঠানেও বাধা, নাগরিক হয়েও সন্দেহ
আহমেদাবাদে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা বরযাত্রীদের মধ্য থেকেও বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা আলমআরা পাঠান বলেন, “২৩ বছর ধরে এখানে আছি। আমার ছেলেও গুজরাটেই জন্মেছে। তবুও আমার ছেলেকে বাংলাদেশি সন্দেহে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
এই ঘটনায় শুধু গুজরাট নয়, ভারতের উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশাতেও বাংলাভাষী মুসলিমদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বলে জানায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’।
আধার ও ভোটার আইডির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
গুজরাট পুলিশ দাবি করছে, আধার কার্ড বা ভোটার আইডি যথেষ্ট প্রমাণ নয়, কারণ সেগুলো নকল হতে পারে। এই কারণে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো থেকে বিশেষ তদন্তকারী দল ডেকে আনা হয়েছে, যারা সন্দেহভাজনদের জাতীয়তা নির্ধারণে সাহায্য করবে।
এই প্রসঙ্গে ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’-এর প্রধান আসিফ ফারুক বলেন, “বাংলাভাষী ও মুসলমান হলেই কি তারা এই দেশে কাজ করতে পারবে না? একজন মানুষ নিজ দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কেবল ভাষা ও ধর্মের কারণে কেন তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হবে?”
মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ ধরনের অভিযান ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। তাঁরা বলছেন, শুধুমাত্র ধর্ম বা ভাষার ভিত্তিতে যেভাবে এই মানুষগুলোকে আটক করা হচ্ছে, তা এক ধরনের জাতিগত প্রোফাইলিং-এর শামিল।
অধিকন্তু, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বৈধ পরিচয়পত্র রয়েছে, তাদের মুক্তি বা সুরক্ষার বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করা হয়নি।
এই অভিযান যে উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে তা যদি সত্যিই অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করাই হয়ে থাকে, তাহলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া এভাবে গণহারে গ্রেফতার মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। বাংলাভাষী মুসলমানদের উপর এই নজরদারি কেবল সামাজিক বৈষম্যই বাড়াবে না, বরং ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন