গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো বর্বর দমন-পীড়নের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর চার্জশিট ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
রবিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বিচার প্রক্রিয়ার সূচনা করে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরাসরি বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।
৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার বিশাল এই অভিযোগপত্রে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় দমননীতি চালিয়ে হাজারো মানুষের মৃত্যু এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এতে ৮১ জন সাক্ষীর তালিকা রয়েছে এবং বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে অন্তত দেড় হাজার মানুষ নিহত ও আড়াই হাজার আহত হন, যার দায়ভার শেখ হাসিনা এবং তার নিকট সহযোগীদের ওপর বর্তায়।
প্রধান অভিযোগসমূহ:
১. গণভবনের বক্তব্য ও উসকানি: ১৪ জুলাই দেওয়া এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার বক্তব্যকে উসকানিমূলক বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক সহিংসতা চালায়।
2. মারণাস্ত্রের ব্যবহার: হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলন দমন ও হত্যার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা, যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
3. আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড: ১৬ জুলাই রংপুরে নিরস্ত্র ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, যা পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়।
4. চাঁনখারপুলে ৬ জন হত্যা: ৫ আগস্ট ঢাকায় নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের মাধ্যমে ৬ জনকে হত্যা।
5. আশুলিয়ায় দগ্ধ করে হত্যা: একই দিনে আশুলিয়ায় ৬ জনকে গুলি করে, পরে ৫ জনের মরদেহ ও একজনকে জীবিত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ।
১৬ জুন আদালতে হাজিরার নির্দেশ
বিচারপতি মজুমদার শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের আগামী ১৬ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে নির্দেশ দেন। তারা অনুপস্থিত থাকলে তাদের ‘পলাতক’ ঘোষণা করে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। এদিন প্রসিকিউটর আসামিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বণ্টনের আবেদনও করেন।
শেখ পরিবারের ‘স্বৈরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার অভিযোগ
প্রসিকিউশনের দাবি, স্বাধীনতার পর থেকেই ধাপে ধাপে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের মাধ্যমে দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭৩-এর নির্বাচনে কারচুপি, রক্ষীবাহিনীর অপব্যবহার, ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ এবং বাকশালের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা হরণ এসব ঘটনাকে তুলে ধরা হয় চার্জশিটে।
ঘৃণার রাজনীতির প্রসঙ্গ
প্রসিকিউটর বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের একক মালিকানা দাবি করে দীর্ঘদিন ধরে ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘রাজাকার’ বা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে ঘৃণার রাজনীতি চর্চা করেছে। এতে সমাজে বিভাজন ও বিদ্বেষমূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
হাসিনার 'গ্যাং অব ফোর'
ট্রাইব্যুনালের তদন্তে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তার ফ্যাসিস্ট শাসনের মূল কারিগর। এরা হলেন—ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক। তাদের পরামর্শেই দেশজুড়ে শেখ মুজিবের নামে স্থাপনা নির্মাণসহ ‘ব্যক্তিপূজার’ সংস্কৃতি চালু হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন