আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে যৌথভাবে আন্দোলনে নামলেও, সম্প্রতি ভার্চুয়াল মাধ্যমে তীব্র বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামী-শিবিরের নেতাকর্মীরা। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ আন্দোলনের ময়দানে একসাথে থাকলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে এখন দুই পক্ষের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মুখে।
দ্বন্দ্বের সূচনা
সম্প্রতি শাহবাগে অনুষ্ঠিত একটি কর্মসূচিতে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের নামে বিতর্কিত স্লোগান এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার দায় এনসিপি নেতাদের ওপর চাপিয়ে সমালোচনা শুরু করেন নেটিজেনরা।
পরবর্তীতে এনসিপির তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ, মুজিববাদী বামপন্থী রাজনীতি এবং পাকিস্তানপন্থী ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান তুলে ধরেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, “যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে এবং পাকিস্তানপন্থা ত্যাগ না করলে রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে না।”
এই স্ট্যাটাসে জামায়াতকে উদ্দেশ করে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হলে, পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানান জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। ফেসবুকে একে একে পোস্ট আসতে থাকে এনসিপি এবং জামায়াতপন্থী একাধিক নেতাকর্মীর পক্ষ থেকে।
বিতর্ক আরও ঘনীভূত
পরবর্তীতে আরও একটি স্ট্যাটাসে মাহফুজ আলম জামায়াতপন্থীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হুঁশিয়ারি দিয়ে লেখেন— “যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগীরা আমার সহনাগরিক নয়, পাকিস্তানপন্থীদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই প্রতিরোধ করা হবে।” যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলেন, তবে স্ক্রিনশট ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে।
এই পোস্ট ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রশিবিরের নেতা সাদিক কাইয়ুম মাহফুজ আলমকে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ আখ্যা দেন এবং জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে একাধিক প্রতিবাদী স্ট্যাটাস প্রকাশ পায়।
এনসিপির অবস্থান
এনসিপির শীর্ষ নেতারাও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সরব হন। দলের মুখ্য সমন্বয়কারী নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, “যারা একাত্তরের গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাদের রাজনীতিকে কঠিন করে তোলা হবে।”
ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার জানান, “আমরা হাসিনার পতনের জন্য আন্দোলন করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের জন্য নয়।”
এনসিপির পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে এনসিপির নেতাকর্মীরা কখনোই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী স্লোগান দেয়নি। শাহবাগে যারা বিতর্কিত স্লোগান দিয়েছে, তারা এর দায়ভার নেবে।”
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
মাহফুজ আলমের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠকে বসে বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “বিভাজনমূলক এ ধরনের বক্তব্য জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী।”
জামায়াত আমির ড. শফিকুর রহমান সামাজিক মাধ্যমে কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান— “যে কোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হবে। উসকানিতে না জড়িয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।”
শাহবাগে প্রতীকী প্রতিবাদ
জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধার প্রতিবাদ জানিয়ে শাহবাগে একদল শিক্ষার্থী সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে। এতে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
---
সংক্ষেপে:
একসময় একক দাবিতে একত্রিত হয়ে রাজপথ কাঁপানো এনসিপি ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া বিভাজন রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কোনো আপোস নয়—এমন অবস্থানে থাকা এনসিপি এখন স্পষ্টভাবে জামায়াতকে ঐতিহাসিক দায় মেনে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতও তাদের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ভার্চুয়াল দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন