কোটা নিয়ে এক বছর আগে হাইকোর্টের রায়ে আন্দোলনের সূত্রপাত ও শেখ হাসিনার পতন

সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের হাইকোর্টের এক বছরের পুরোনো রায় থেকেই সূচনা হয়েছিল ইতিহাস বদলে দেওয়া এক আন্দোলনের। সেই আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় দেশের দীর্ঘদিনের শাসক দল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা হারান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত বছরের ৫ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্যান্য সংরক্ষিত কোটাগুলো পুনর্বহাল হয়। শুরু হয় মতবিরোধ।

রায় ঘোষণার দিন রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী জানান, রায়ের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা আবার চালু হবে। তবে অন্যান্য কোটাগুলোর বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি। অবশেষে ১৪ জুলাই হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি নারী, জেলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী কোটাও বহাল রাখার আদেশ আসে।

২০১৮ সালের আগে যে কাঠামো ছিল, তাতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও জেলা ও নারী কোটায় ১০ শতাংশ করে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ সংরক্ষণ ছিল। নতুন রায়ে এসব কোটার পূর্ণ পুনর্বহাল করে তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারির নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে আদালত এটাও বলে, সরকার চাইলে কোটার হার কমাতে বা বাড়াতে পারবে। আর কোটা পূরণ না হলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা যাবে।

আন্দোলনের আগুনে দগ্ধ হয় সরকার

পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগে থেকেই শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু রায় প্রকাশের পর তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সরকার আপিল করলেও ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে এবং শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে ৭ আগস্ট। যদিও পরে শুনানি এগিয়ে আনা হয় এবং ২১ জুলাই আপিল বিভাগ নির্দেশ দেয়, সরকারি চাকরিতে কোটা থাকবে ৭ শতাংশ।

ততক্ষণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।

১৪ জুলাই রায় প্রকাশের পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদে সারাদেশে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন জেলায় নিহত হয় অন্তত ছয়জন। রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

কারফিউ, সেনা মোতায়েনেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সরকার

পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে ও কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে। কিন্তু জনরোষ থামানো যায়নি। বরং নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি ও দমন-পীড়নের মুখে সাধারণ মানুষও ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। আন্দোলনে নামেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও।

একপর্যায়ে আন্দোলন ‘একদফা’ দাবিতে রূপ নেয়—শেখ হাসিনার পদত্যাগ। ৩ আগস্ট এই দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

৫ আগস্ট ঢাকায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ঘটে নাটকীয় পরিবর্তন—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। অবসান ঘটে তাঁর টানা সাড়ে ১৬ বছরের শাসনামলের।

শেষে জয় বললেন, ভাবিনি এমন হবে

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা কেউই ভাবিনি এই সহিংস আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনে গিয়ে ঠেকবে।”

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন