ইজরায়েলের ভূমি দখলের মূল মন্ত্র: তারা “গডস চোজেন পিপল”


ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তানাখে, বিশেষ করে তৌরাতে (সেকেন্ড রেভলেশন ৭:৬), ইজরায়েলিযদের গডের (আল্লাহ, রব) নির্বাচিত জনগণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরা ইয়াকুবের (আ:)(যিনি ইজরায়েল নামেও পরিচিত) বংশধর, যাদের আল্লাহ ইব্রাহিম আ:, ইসহাক আ: এবং ইয়াকুবের আ: সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে নির্বাচিত করেছেন। এই নির্বাচনের অর্থ আল্লাহর আদেশ পালন এবং কানান দেশে (আধুনিক ইজরায়েল/ফিলিস্তিন) বসবাসের দায়িত্ব।
“ইহুদি” শব্দটি পরবর্তীতে (ব্যাবিলনীয় নির্বাসনের পর) ইহুদা গোত্রের জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তানাখের ইজরায়েলিরা প্রধানত ইয়াকুবের আ: বংশধর।
খ্রিস্টান বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট তানাখের মতোই ইজরায়েলিদের ঈশ্বরের (আল্লাহর) নির্বাচিত জনগণ হিসেবে বর্ণনা করে। নিউ টেস্টামেন্ট (যেমন, রোমানস ১১:১-২), ইজরায়েলিদের প্রতি ঈশ্বরের (আল্লাহর) চুক্তি অব্যাহত থাকে, তবে যিশুর (ঈশা আ:) মাধ্যমে এই নির্বাচন সকল বিশ্বাসীদের (ইহুদি ও অ-ইহুদি) মধ্যে প্রসারিত হয়। তবুও, ঐতিহাসিকভাবে ইজরায়েলিরা ইয়াকুবের আ: বংশধর হিসেবে বিবেচিত।
কুরআনে (সূরা আল-বাকারা ২:৪৭, ২:১২২) “বনি ইজরায়েল” (ইজরায়েলের সন্তান) কে আল্লাহর নির্বাচিত জনগণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের মূসার আ: মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এরা ইয়াকুবের (যার ওপর নাম ইজরায়েল) আ: বংশধর হিসেবে বিবেচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুসারে, কানানীয়রা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০-১২০০ সালে লেভান্তে (আধুনিক ইজরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান) বসবাসকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠী। তানাখ অনুসারে, ইজরায়েলির কানানীয়দের মধ্য থেকে উদ্ভূত হয় বা তাদের সাথে মিশ্রিত হয়, যারা ইয়াকুবের আ: বংশধর হিসেবে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলে। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-১০০০ সালে ইজরায়েলি গোত্রগুলো (১২ টি) একত্রিত হয়ে ইজরায়েলি ও ইহুদা রাজ্য গঠন করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে উত্তরের দশটি গোত্র (ইজরায়েলি রাজ্য) আসিরিয়ানদের দ্বারা নির্বাসিত হয়, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ইহুদা রাজ্য ব্যাবিলনীয়দের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই নির্বাসনের পর ইহুদি পরিচয় (ইহুদা গোত্র থেকে) প্রাধান্য পায়।
রোমান আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দী-খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী) ইহুদিদের আরও নির্বাসন ডায়াস্পোরা সৃষ্টি করে, যার ফলে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি সম্প্রদায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে, লেভান্তে কিছু জনগোষ্ঠী অবশিষ্ট থাকে, যারা পরবর্তীতে ফিলিস্তিনি হিসেবে পরিচিত হয়।
খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের বিস্তারের মাধ্যমে আরবরা লেভান্তে ছড়িয়ে পরে, যাদের সংস্পর্শে এসে স্থানীয় লেভান্তের জনগোষ্ঠী (যাদের অনেকেই ইহুদি এবং খ্রিষ্টান), যারা কানানীয় ও ইসরাইলিদের বংশধর, পরবর্তীতে আরব সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করে।
মনে রাখা দরকার ফিলিস্তিনিদের জেনেটিক প্রোফাইল আরব জনগোষ্ঠীর তুলনায় কানানীয়/লেভান্তীয় বৈশিষ্ট্য বেশি প্রকাশ করে। মানে, আরবরা ফিলিস্তিনিদের থেকে ভিন্ন জনগোষ্ঠী। আবার কানানীয় থেকে ইয়াকুব আ: এর বংশধর, অর্থাৎ, ইজরায়েলিদের ধারাবাহিকতা লেভান্তে জেনেটিক্যালি প্রতিষ্ঠিত।
২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৫ টি উল্লেখযোগ্য জেনেটিক গবেষণা প্রমাণ করে যে ফিলিস্তিনি এবং ইহুদি ইজরায়েলি উভয়ই প্রাচীন লেভান্তীয় (কানানীয়) বংশধর, তবে ফিলিস্তিনিরা কানানীয় এবং প্রাচীন ইজরায়েলিদের (ইয়াকুবের বংশধর) জেনেটিক প্রোফাইলের সাথে বেশি মিল প্রকাশ করে।
আধুনিক জেনেটিক প্রমানে প্রধান গবেষণাগুলো উল্লেখ করা হলো:
১) Agranat-Tamir et al. (2020) S0092-8674(20)30487-6:
খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-১০০০ সালের কানানীয় ডিএনএ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফিলিস্তিনি, লেবানিজ এবং সিরিয়ানরা এই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে কাছের বংশধর। ইহুদি ইজরায়েলিদের মধ্যে মিজরাহি ইহুদিরা কাছাকাছি, কিন্তু আশকেনাজি এবং সেফার্ডি ইহুদিদের ইউরোপীয়/উত্তর আফ্রিকান মিশ্রণ তাদের দূরত্ব বাড়ায়।
২) Haber et al. (2017, Nature Communications), S 41467-017-00586-0:
সিডন, লেবাননের কানানীয় ডিএনএ (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০০-২০০০) ফিলিস্তিনি এবং লেবানিজদের সাথে সর্বাধিক মিল দেখায়। ইহুদি ইজরায়েলিদের মধ্যে মিজরাহি ইহুদিরা কাছাকাছি, কিন্তু আশকেনাজিদের ইউরোপীয় মিশ্রণ (~৫০%) তাদের কম মিল দেখায়।
৩) Harney et al. (2021), S0092-8674(21)00817-5:
লোহিত যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৬০০) লেভান্তীয় ডিএনএ ফিলিস্তিনি এবং লেবানিজদের সাথে সবচেয়ে কাছাকাছি। যারা প্রাচীন ইজরায়েলিদের (ইয়াকুবের বংশধর) প্রতিনিধিত্ব করে। ইহুদি ইজরায়েলিদের মধ্যে মিজরাহিরা কাছাকাছি, কিন্তু আশকেনাজি/সেফার্ডির মিশ্রণ তাদের দূরত্ব বাড়ায়।
৪) Behar et al. (2010, Nature), 09103:
ফিলিস্তিনিরা প্রাচীন লেভান্তীয় জনগোষ্ঠীর সাথে কম মিশ্রণের কারণে বেশি মিল দেখায়। ইহুদি ইস্রায়েলীদের মধ্যে আশকেনাজি (৩০-৭০% ইউরোপীয়) এবং সেফার্ডির মিশ্রণ তাদের কানানীয়/ইস্রায়েলীয় বংশ থেকে দূরে সরিয়েছে।
৫) Carmi et al. (2014, Nature Communications), ncomms5835:
আশকেনাজি ইহুদিদের ৫০% ইউরোপীয় বংশ তাদের কানানীয়/ইস্রায়েলীয় ডিএনএ থেকে দূরে সরিয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা স্থানীয় ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে
ফিলিস্তিনিরা ন্যূনতম বহিরাগত মিশ্রণ এবং লেভান্তে দীর্ঘকালীন উপস্থিতির কারণে কানানীয় এবং লোহিত যুগের ইজরায়েলিদের (ইয়াকুবের বংশধর) জেনেটিক প্রোফাইলের সাথে বেশি মিল দেখায়। তাদের Y-ক্রোমোজোম (J1, J2) এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (H, T, J) লেভান্তীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।
উপরের পাঁচটি জেনেটিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে জনসংখ্যা হিসেবে ফিলিস্তিনিরা কানানীয় এবং প্রাচীন ইজরায়েলিদের (ইয়াকুবের বংশধর) জেনেটিক প্রোফাইলের সাথে ইহুদি ইজরায়েলিদের তুলনায় বেশি কাছাকাছি। মিজরাহি ইহুদিরা তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি, কিন্তু আশকেনাজি এবং সেফার্ডি ইহুদিদের মিশ্রণ ইহুদি ইজরায়েলি জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক ভাবে দূরে। গাজা কিংবা ওয়েস্ট ব্যাংকে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরাই প্রাচীন জেনেটিক ধারাবাহিকতা সবচেয়ে বেশি বজায় রেখেছে। যাদের মাঝে খ্রিষ্টান আর মুসলমান উভয়েই আছে, যারা হাজার বছর ধরে ওই ভূখণ্ডে বাস করছে।
তানাখ, খ্রিস্টান বাইবেল এবং কুরআন ইজরায়েলিদের (ইয়াকুবের বংশধর) আল্লাহর নির্বাচিত জনগণ হিসেবে উল্লেখ করে। যা আধুনিক ফিলিস্তিনি, ইহুদি ইজরায়েলি , সিরিয়ান এবং লেবানিজদের মধ্যে বিদ্যমান। তাহলে গডের (আল্লাহর) প্রমিস ফিলিস্তিনি, লেবানিজ, সিরিয়ান, ইজরায়েলি সকল মানুষের জন্যই প্রযোজ্য, যারাই আল্লাহকে বিশ্বাস করে; কেবল এখনকার ইহুদিদের জন্য নয়।

সাবিনা আহমেদ
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামরিক বিশ্লেষক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন