হাসিনার দুঃস্বপ্নই কাল হলো আওয়ামী লীগের

হাসিনার দুঃস্বপ্নই কাল হলো আওয়ামী লীগের

 ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা যেটুকু ছিল, তাও বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দলের প্রধান শেখ হাসিনার একগুঁয়ে মনোভাব এবং সরকার পতনের ব্যর্থ ষড়যন্ত্র পুরো দলকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। ফলে শনিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এখন দলটির নিবন্ধন বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।


বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নেতারা জানান, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও দলের নেতাকর্মীদের রক্ষা বা দিকনির্দেশনায় ব্যর্থ হন। বরং তিনি সেখান থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতে উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। এই উসকানির ফলে অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।


সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ ‘আওয়ামী লীগ’


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, সন্ত্রাস ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘আওয়ামী লীগ’ নামের রাজনৈতিক দলটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে দলটির বিচার শুরু হবে। এই আইনের অধীনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ থাকবে যতক্ষণ না বিচার শেষ হয়।


বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: নেতৃত্বের ব্যর্থতায় পতন


গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন বলেন, শেখ হাসিনার পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্ব দলের পতনের অন্যতম কারণ। তার মতে, এত বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পরও শেখ হাসিনা অনুশোচনাহীনভাবে বিদেশ থেকে নেতাকর্মীদের উসকে দিচ্ছেন।


জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, গণহত্যার বিচারই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। একই সুরে গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার অপকর্মের দায়ভার এখন গোটা দলকে বহন করতে হচ্ছে।


গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জোনায়েদ সাকি অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে এখনো ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, দেশের জনগণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি এই ষড়যন্ত্রে চরম ক্ষুব্ধ।


নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ-উর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের ফল।


সাংবাদিক ও অভ্যন্তরীণ সূত্রের অভিমত


সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল প্রশ্ন তোলেন—গত নয় মাসে আওয়ামী লীগ কী এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে যে, হঠাৎ করে দলটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হলো।


কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা এক শীর্ষ নেতা জানান, শেখ হাসিনা বাস্তবতা মেনে নিতে না পারায় একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার খেসারত এখন দলকে দিতে হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে থাকা আরেক নেতা বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতার মোহে নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতেন না, এবং ক্ষমতা হারালেও নিজেকে এখনো প্রধানমন্ত্রী মনে করেন।


জনসম্পদের লুটপাট ও দায়মুক্তির প্রশ্ন


গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নেতারা যে সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন, তা বাজেয়াপ্ত করে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। তিনি দলের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী ও ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার অভিযোগ তুলে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানান।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত এই দলটি ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা দলটি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একাধিকবার বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য সমালোচিত হয়েছে। এর আগে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দলটি একদলীয় শাসনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন